বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারির জন্য কোবাল্ট ও নিকেলের মতো বিরল ধাতুর ওপর নির্ভরতা কমাতে এক নতুন প্রযুক্তি নিয়ে এসেছেন বিজ্ঞানীরা। ডিআরএক্স নামের এই ব্যাটারি পরিবেশবান্ধব এবং অর্থনৈতিকভাবে অনেক সাশ্রয়ী। কোবাল্ট ও নিকেল-মুক্ত ডিআরএক্স ব্যাটারি প্রযুক্তির উদ্ভাবন বৈদ্যুতিক গাড়ির ভবিষ্যৎকে কীভাবে বদলে দিচ্ছে? জেনে নিন এই নতুন আবিষ্কারের অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত প্রভাব।
বৈদ্যুতিক গাড়ির (ইভি) ব্যাটারি প্রযুক্তি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা চলছে। এ পর্যন্ত আমরা যে ব্যাটারিগুলো ব্যবহার করে আসছি, সেগুলোর প্রধান সমস্যা হলো কোবাল্ট ও নিকেলের মতো বিরল ও ব্যয়বহুল ধাতুর ওপর নির্ভরতা। এই ধাতুগুলো উত্তোলনের প্রক্রিয়া যেমন ব্যয়বহুল, তেমনি পরিবেশের জন্যও ক্ষতিকর। আমার মনে আছে, যখন প্রথম ইলেকট্রিক গাড়ির কথা শুনতাম, তখন ব্যাটারির দাম ও স্থায়িত্ব নিয়েই সবচেয়ে বেশি প্রশ্ন উঠত। তবে সম্প্রতি একদল বিজ্ঞানী একটি যুগান্তকারী উদ্ভাবন করেছেন, যা এই সব সমস্যার সমাধান দিতে পারে। তারা এমন একটি পরবর্তী প্রজন্মের ব্যাটারির ক্যাথোড তৈরি করেছেন, যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘ডিজঅর্ডারড রক-সল্ট’ বা ডিআরএক্স।
এই লেখায় আমরা এই নতুন বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারি প্রযুক্তির আদ্যোপান্ত আলোচনা করব। কীভাবে এই প্রযুক্তি জাপানের মতো দেশগুলোর অর্থনৈতিক পরিকল্পনাকে হুমকির মুখে ফেলছে, কেন এটি পরিবেশের জন্য ভালো এবং এর সুবিধা-অসুবিধা কী—এসব কিছুই বিস্তারিত জানব।
এই আর্টিক্যালে যা জানবেন
- প্রচলিত বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারির সমস্যাগুলো।
- ডিআরএক্স ব্যাটারি প্রযুক্তি কী এবং এর মূল বৈশিষ্ট্য।
- এই উদ্ভাবনের অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত প্রভাব।
- নতুন প্রযুক্তির সুবিধা এবং এর ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা।
১. বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারি: বিরল ধাতুর চ্যালেঞ্জ
বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারিতে লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারিই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। এই ব্যাটারির মূল উপাদানগুলোর মধ্যে কোবাল্ট ও নিকেল অন্যতম। এই বিরল ধাতুগুলো উত্তোলনের জন্য প্রায়ই কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ প্রক্রিয়ার সাহায্য নিতে হয়। জাপানের কথাই ধরুন। দেশটির মিনামি-টোরি-শিমার কাছে গভীর সমুদ্রে প্রায় ২ হাজার ৬০০ কোটি ডলার মূল্যের কোবাল্ট ও নিকেলের এক বিশাল খনি আবিষ্কৃত হয়েছিল। জাপান সরকার ২০২৬ সালের মধ্যে সেখানে বৃহৎ আকারে খনন শুরু করার পরিকল্পনা করেছিল। এর জন্য প্রকৌশলীরা অনেকদূর কাজও এগিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু নতুন এই উদ্ভাবন সেই বিশাল অর্থনৈতিক প্রকল্পকে একরকম অনিশ্চয়তার মুখে ফেলে দিয়েছে।
১.১ গভীর সমুদ্র খননের বিপদ
গভীর সমুদ্র থেকে বিরল ধাতু উত্তোলনের ব্যাপক বিরোধিতা করছেন সামুদ্রিক বিজ্ঞানীরা। তাদের মতে, এ ধরনের খনন গভীর সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্রের মারাত্মক ক্ষতি করছে। মিনামি-টোরি-শিমার মতো দ্বীপগুলোর আশপাশের স্থানীয় মাছ ও চিংড়ির সংখ্যা বেশ কমে গেছে, যা এই ধরনের খননেরই ফল। তাই কোবাল্ট ও নিকেলের চাহিদা কমে এলে এই ধরনের পরিবেশবিরোধী খননও কমে আসবে, যা সত্যিই আশার খবর।
২. সমাধান নিয়ে আসছে নতুন ডিআরএক্স ব্যাটারি প্রযুক্তি
কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়ার বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে যৌথভাবে এই নতুন প্রযুক্তির ব্যাটারি ক্যাথোড তৈরি করেছেন। এই ব্যাটারির সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, এটি কোবাল্ট ও নিকেলের মতো বিরল ও ব্যয়বহুল ধাতুর বদলে ডিজঅর্ডারড রক-সল্ট (ডিআরএক্স) কণা ব্যবহার করে।
২.১ ডিআরএক্স ব্যাটারির মূল বৈশিষ্ট্য
- কোবাল্ট ও নিকেল-মুক্ত: এই ব্যাটারি তৈরিতে কোবাল্ট ও নিকেলের কোনো প্রয়োজন নেই, যা এর উৎপাদন খরচ অনেক কমিয়ে আনবে।
- পরিবেশবান্ধব: বিরল ধাতু উত্তোলনের পরিবেশগত ক্ষতিকর প্রক্রিয়া থেকে মুক্তি মিলবে। এটি পরিবেশগতভাবে অনেক বেশি টেকসই।
- উচ্চ শক্তি ঘনত্ব: ডিআরএক্স ক্যাথোডের ব্যাটারি বর্তমান লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির চেয়ে বেশি শক্তি ঘনত্ব ধারণ করে। এর ফলে একই আকারের ব্যাটারি আরও বেশি দূরত্বে গাড়ি চালাতে সক্ষম হবে।
- সস্তা উৎপাদন: বিরল ধাতুর বদলে সহজেই পাওয়া যায় এমন শিলা ও লবণকণা ব্যবহার করায় এই ব্যাটারি উৎপাদন বেশ সস্তা।
৩. অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত প্রভাব
ডিআরএক্স ব্যাটারির আবিষ্কার নিঃসন্দেহে একটি বড় পরিবর্তন নিয়ে আসবে। এর ফলে একদিকে যেমন প্রযুক্তির উন্নতি হবে, অন্যদিকে এর অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত কিছু প্রভাবও দেখা দেবে।
৩.১ ডিআরএক্স ব্যাটারির সুবিধা ও অসুবিধা
সুবিধা:
- কম খরচ: ব্যাটারির উৎপাদন খরচ কমে যাওয়ায় বৈদ্যুতিক গাড়ির দামও কমে আসবে, যা সাধারণ মানুষের জন্য ইভিকে আরও সহজলভ্য করে তুলবে।
- দীর্ঘমেয়াদি স্থায়িত্ব: উচ্চ শক্তি ঘনত্বের কারণে ব্যাটারির কর্মক্ষমতা বাড়বে।
- পরিবেশের সুরক্ষা: গভীর সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্র সুরক্ষিত থাকবে।
অসুবিধা:
- আর্থিক হুমকি: জাপানের মতো যে সব দেশ বিরল ধাতু উত্তোলনের জন্য বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করেছে, তাদের সেই অর্থনৈতিক কার্যকারিতা হুমকির মুখে পড়বে।
- বাজারের অস্থিরতা: কোবাল্ট ও নিকেলের চাহিদা কমে আসায় এর বাজারমূল্যে বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে।
বৈদ্যুতিক গাড়ির ভবিষ্যৎ নিয়ে যারা চিন্তিত ছিলেন, নতুন ডিআরএক্স ব্যাটারি প্রযুক্তি তাদের জন্য আশার আলো দেখাচ্ছে। কোবাল্ট ও নিকেলের মতো বিরল ধাতুর ওপর নির্ভরশীলতা কমে এলে শুধু ব্যাটারির উৎপাদন খরচই কমবে না, বরং আমাদের গ্রহের পরিবেশও রক্ষা পাবে। এই ধরনের টেকসই উদ্ভাবনই আমাদের ভবিষ্যতের পথ দেখাবে।
আপনার যদি এই বিষয়ে আরও কিছু জানার থাকে, তাহলে কমেন্ট বক্সে আমাদের জানাতে পারেন। আপনার বন্ধুদের সঙ্গে এই আর্টিকেলটি শেয়ার করে তাদেরও এই নতুন প্রযুক্তি সম্পর্কে জানতে সাহায্য করুন।
সূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া
সম্পর্কিত আর্টিকেল: কীভাবে Upwork-এ প্রথম ক্লায়েন্ট পাবেন: ধাপে ধাপে গাইড